মো. শফি উল্লাহ রিপন,
বিদ্যুতের ভুল বিলিং অতি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এক মাসে যে বিদ্যুত্ ব্যবহার করছেন তার পরিবর্তে অতিরিক্ত বিল ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে অসংখ্য গ্রাহককে। বিশাল অঙ্কের ভূতুড়ে বিল দেখে অনেকে অতিষ্ঠ, আবার গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো হয়ে পড়েন আতঙ্কিত। এ ধরনের ভুলের শিকার হলে কেউ প্রতিকার পান আবার কেউ পান না। হয়রানি কিংবা বিদ্যুত্ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হবার ভয়ে অনেকে ভূতুড়ে বিলই পরিশোধ করে দেন।
মিটার না দেখেই প্রতিনিয়ত গ্রাহকদের ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে বিদ্যুৎ বিল। ফলে ব্যবহৃত ইউনিটের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হচ্ছে। বাসায় বাসায় গিয়ে মিটারের রিডিং দেখে বিল তৈরি করার কথা থাকলেও প্রতি মাসে অফিসে বসেই অনুমাননির্ভর ভুতুড়ে বিল তৈরি করে গ্রাহকদের কাছে বিলি করছেন ফেনীর বিপিডিবি বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ও ফেনী পল্লি বিদ্যৎ সমিতির এমন ভুতুড়ে বিলের অভিযোগ এখন ফেনীর অধিকাংশ মানুষের।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ফেনী সুত্র জানায়, গত জুলাই মাসে বিদ্যৎ বিল ছিল 11 কোটি ৫১ লাখ টাকা, যার মধ্যে ৭৭ লাখ টাকার বিল গ্রাহক অভিযোগের ভিত্তিতে সমন্বয় করা হয়। প্রতিদিন গড়ে 45/50 জন গ্রাহক বিল সংক্রান্ত নানা অভিযোগ নিয়ে আসে। সামান্য সমস্যা হলে অভিযোগ লিপিবদ্ধ করা ছাড়াই সমাধান করা হয় বলে জানান। তবে প্রিপেইড গ্রাহকদের ক্ষেত্রে অভিযোগ অনেক কম। মাঝে মাঝে কার্ড এন্টিতে সমস্যা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। ফেনী পল্লি বিদ্যৎ সমিতিতে গত মাসে মাত্র 2টি অভিযোগ এসেছে বলে জানা যায়
ফেনীতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) মোট গ্রাহক সংখ্যা ৯৩ হাজার , এর মধ্যে ১৪ হাজার প্রিপেইড গ্রাহক। পোষ্ট পেইড 79 হাজার গ্রাহকের মিটার রিড়িং এর জন্যে রয়েছেন 39 জন। ফেনী পল্লি বিদ্যৎ সমিতির ৪ লাখ গ্রাহকের জন্য রয়েছে ১৬৬ জন মিটার রিড়ার। তবে মিটার রিড়াররা সময় সল্পতার কারনে অধিকাংশ মিটার না দেখেই পূর্ববর্তী মাসের সাথে সামযস্য রেখে বিল করে দেন্ । এতে গ্রাহকের মুল ব্যবহত ইউনিটের তারতম্য ঘটে।
নাম প্রকাশে অনিচছুক একজন মিটার রিড়ার বলেন, স্বল্প সময়ে একজন মিটার রিড়ার কযেক হাজার মিটার কাউন্ট করা সম্বব হয়না। আবার নতুন নতুন এলাকায় মিটার রিড়িং করতে গিয়ে নানা সমস্যায় পড়তে হয়। তবে তিনি শিকার করেন মাঝে মাঝে পূর্ববর্তী মাসের সাথে মিলিয়ে চলমান মাসের বিল করতে হয়।
ফেনী পল্লি বিদ্যৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার হাওলাদার মোহাম্মদ ফজলুর রহমান বলেন, পল্লি বিদ্যৎ সমিতির মিটার রিড়াররা মাঝে মাঝে দেরীতে গিযে মিটার কাইন্ড করে। ফলে কোন মাসে ৩৫ দিনের বিল হরেও পরবর্তী মাসে ২৫ দিনের বিল করা হয়। অতিরিক্ত বা ভূতুড়ে বিল করার কোন সুযোগ নেই। তার পরও কোন কোন অভিযোগ পেলে আমরা দ্রুত সমস্যা চিহ্রিত করে তা সমাধান করা হয় এবং অভিযুক্ত ব্যাক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়।
সাম্প্রতি জেলা প্রশাসকের মাসিক উন্নয়ন ও সমন্বয় সভায় ফেনী শহর ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি আবুল কাসেম চৌধুরী অর্ধশতাধিক বিদ্যুত বিলের কপি উত্থাপন করে অভিযোগ করেন, গত মাসে যে বিল ছিন ৬০০ টাকা পরবর্তী মাসে সে মিটারে বিল এসেছে 5 হাজার টাকার মত। কয়েকটি বিলের সাথে মিটারে ইউনিটের সংখ্যার সম্পর্ক নেই। তিনি আরো বলেন, কয়েক দফায় বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। এ অবস্থায় ফেনীতে গ্রাহকরা ব্যবহৃত বিদ্যুতের বিল পরিশোধে যখন হিমশিম খাচ্ছেন। বিদ্যুৎ অফিসের দায়িত্বরতরা মিটার না দেখেই ইচ্ছেমতো গ্রাহকদের ধরিয়ে দিচ্ছেন বাড়তি বিলের কাগজ। ফলে প্রতি ইউনিটে যোগ হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। কোনো কোনো মাসে দুই থেকে তিনগুণ টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। আর বিল পরিশোধ না করতে পারলেই করা হচ্ছে লাইন বিচ্ছিন্ন। এমন অবস্থা চলমান থাকলেও সংশ্লিষ্ট অফিসে ধরনা দিয়েও মিলছে না স্থায়ী কোনো সমাধান।
ভুক্তভোগী গ্রাহক জাহাঙ্গীর আলম জানান, তার বিদ্যুৎ মিটারে উল্লেখ রয়েছে ৬ হাজার ৩ শত ২৩ ইউনিট। অথচ বিদ্যুৎ অফিস থেকে তাকে দেয়া হয়েছে ৬ হাজার ৪৯৫ ইউনিটের বিল। এভাবে বাড়তি বিলের টাকা পরিশোধ করেছেন তিনি। অতিরিক্ত বিলের ইউনিট পরবর্তী মাসে সমন্বয় করে দেবেন বলে জানায় বিদ্যৎ বিভাগ।
ভুক্তভোগী গ্রাহক ইমরান বলেন, সে তার দোকানে বিদ্যুৎ সংযোগ নেয়ার সাড়ে তিন বছর পর প্রথম তাকে বিদ্যুৎ বিল দেয়া হয় ৩৭ হাজার টাকার। কিন্তু সে বিলটির টাকা পরিশোধ করতে না পাড়ায় তার নামে মামলা দায়ের করা হয়। এখন দীর্ঘদিন ধরে তাকে এ মামলায় কিছু দিন পরপর হাজিরা দিতে হচ্ছে।
বিপিডিবি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রাহক যে পরিমাণ বিদ্যুত্ ব্যবহার করে সেই স্লটের ওপর বিদ্যুত্ বিল নির্ধারণ করে বিতরণকারী সংস্থা-কোম্পানিগুলো। এর সঙ্গে ডিমান্ড চার্জ এবং মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) যুক্ত হয়। একজন গ্রাহক যত বেশি পরিমাণ বিদ্যুত্ ব্যবহার করেন তার মাসিক বিল তত বেশি মূল্যহারে নির্ধারিত হয়।
সর্বশেষ মূল্য বৃদ্ধির সময় বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট এখন 4.19 টাকা। ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য নতুন মূল্য 8.53 টাকা; অফ-পিক 6.80 টাকা এবং পিক আওয়ার 10.24 টাকা; নতুন মূল্য ইউনিট প্রতি 12 টাকা, ধর্মীয় শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান 6.2 টাকা, রাস্তার বাতি 7.70 টাকা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ফ্ল্যাট ইউনিট 9.27 টাকা এবং পিকে 12.34 টাকা। লাইফ লাইনসহ (৫০ বা তার চেয়ে কম ইউনিট ব্যবহারকারী) সাত শ্রেণিতে গ্রাহকদের ভাগ করেছে এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। সে অনুযায়ী মাসে ০ থেকে ৭৫ ইউনিট (কিলোওয়াট) পর্যন্ত বিদ্যুত্ ব্যবহার করলে গ্রাহককে প্রতি ইউনিট ৪ টাকা ১৯ পয়সা হারে বিল দিতে হয়। এরপর দ্বিতীয় ধাপের (৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট) প্রতি ইউনিট ৫ টাকা ৭২ পয়সা, তৃতীয় ধাপে (২০১ থেকে ৩০০) ৬ টাকা, চতুর্থ ধাপে (৩০১ থেকে ৪০০) ৬ টাকা ৩৪ পয়সা, পঞ্চম ধাপে (৪০১ থেকে ৬০০) ৯ টাকা ৯৪ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের বেশি বিদ্যুত্ ব্যবহারকারীদের ষষ্ঠ ধাপের গ্রাহক হিসেবে ১১ টাকা ৪৬ পয়সা হারে বিল শোধ করতে হয়। একজন গ্রাহক মাত্র ১ ইউনিট বিদ্যুতের কারণে পরের ধাপের বিলিংয়ে পড়ে যেতে পারেন। এতে তার টাকার অঙ্কেও হতে পারে ব্যাপক তারতম্য। তাই মিটার রিডাররা চাইলেই ইউনিট কমবেশি লিখে ভূতুড়ে বিলের ফাঁদে ফেলে দিতে পারে যে কোনো গ্রাহককে।
কয়েকজন গ্রাহক জানান, শীত এবং গরমকালভেদে বিদ্যুত্ ব্যবহারে পার্থক্য হয়। শীতকালে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) এবং ফ্যানের ব্যবহার কম হওয়ায় বিদ্যুতের ব্যবহারও কমে। আর গরমে সেটি বেড়ে যায়। গ্রাহক অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ধরা যাক—একটি বাসায় প্রতি মাসে ৪০০ ইউনিটের মধ্যে বিদ্যুত্ ব্যবহার সীমাবদ্ধ থাকে। সে হিসেবে ডিমান্ড চার্জ ও ভ্যাট ছাড়া ঐ বাসার বিদ্যুত্ বিল আসবে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৫৩৬ টাকা। কিন্তু মিটার রিডার দুই মাস রিডিং না নিয়ে বা মিটার না দেখে তার মাসিক বিল করল ৩৫০ ইউনিট ধরে। পরে তৃতীয় মাসে গিয়ে তিনি আগের দুই মাসের সঞ্চিত ১০০ ইউনিট ঐ মাসের সঙ্গে যোগ করে ৫০০ ইউনিটের বিল তৈরি করলেন। ব্যবহারের এ পরিমাণ বৃদ্ধির কারণে গ্রাহক চতুর্থ থেকে পঞ্চম ধাপের গ্রাহক হিসেবে হাতে বিল পান। অথচ প্রকৃত অর্থে তিনি চতুর্থ ধাপের গ্রাহক।
দায়িত্বে অবহেলাজনিত এ বিলিং জালিয়াতির কারণে ঐ গ্রাহককে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৬ টাকা ৩৪ পয়সার পরিবর্তে ৯ টাকা ৯৪ পয়সা হারে পরিশোধ করতে হবে। অর্থাৎ ২ হাজার ৫৩৬ টাকার পরিবর্তে ৪ হাজার ৯৭০ টাকা বিল দিতে হবে। মিটার রিডার আগের দুই মাসের জমে থাকা ইউনিট এই মাসে ঢুকিয়ে দেওয়ার কারণে খরচ দ্বিগুণ হয়ে গেল। সীমিত আয়ের মানুষের জন্য এ অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করা কঠিন। সে কঠিন দায়ই বছরের পর বছর বয়ে বেড়াচ্ছেন অগণিত গ্রাহক।
বছরের পর বছর এ ধারা চললেও সমাধান মিলছে না। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গ্রাহকদের নিজেদেরকেই এ ভুল এবং জালিয়াতি বন্ধে উদ্যোগী হতে হবে। আর যতদিন সব গ্রাহকের আঙ্গিনায় প্রিপেইড মিটার না বসছে ততদিন এ অসংগতি ও হয়রানির টেকসই সমাধানও হবে না জানান অনেকে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ফেনী নির্বাহী প্রকৌশলী আ.স.ম. রেজাউন নবী বলেন, গ্রাহকদের অভিযোগ থাকলেও আমরা তা সমাধানের চেষ্ঠা করি। অনে ক্ষেত্রে গ্রাহক না বুঝেই অভিযোগ করেন। তবে শ্রীঘই আমরা ফেনীতে ৭৭ হাজার অনলাইন প্রিপেইড মিটার নিয়ে আসছি। ফলে সমস্যাও অনেকাংশে কমে যাবে।
ফেনীর জেলা প্রশাসক মোসাম্মৎ শাহীনা আক্তার মিটার রিড়িংয়ে বিপিডিবি কতৃপক্ষকে আরো সর্তক হওয়ার হওয়ার আহবান জানান। গ্রাহকদের অভিযোগ দ্রুত সমাধানের তাগিদ দেন। তিনি বলেন, বিদ্যুত ব্যবহারের ক্ষেতে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
- » বাংলাদেশ সম্মিলিত শিক্ষক সমাজ ফেনী জেলা আহবায়ক কমিটি গঠিত
- » ফেনী বন্ধুসভার বৃক্ষরোপণ ও বিতরণ
- » আমার দেশ সম্পাদকের রত্নগর্ভা মাতা অধ্যাপিকা মাহমুদা বেগমের মাগফিরাত কামনায় ফেনীতে দোয়া
- » গাজীপুরে সাংবাদিক তুহিন হত্যার প্রতিবাদে ফেনীতে সাংবাদিকদের মানববন্ধন
- » ফেনীতে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাংবাদিকদের উপর হামলার গোপন পরিকল্পনা ফাঁস
- » জনতার অধিকার পার্টির চেয়ারম্যানের উপর হামলা, সংবাদ সম্মেলন
- » ফেনী পৌর বিএনপির সদস্য নবায়ন কর্মসূচি উদ্বোধন
- » ফেনীতে হেফাজতের দোয়া মাহফিলে আজিজুল হক ইসলামাবাদী- ‘আলেম সমাজ ঐক্যবদ্ধ থাকলে দেশে আর ফ্যাসিবাদ সৃষ্টি হবে না’
- » ফেনীতে হাফেজ তৈয়ব রহ. স্মরণে দোয়ার মাহফিল
- » ছাত্র জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে ফেনীতে বিএনপি’র বর্ণাঢ্য বিজয় মিছিল, সমাবেশ “গণহত্যার দ্রুত বিচার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবি”