মো. শফি উল্লাহ রিপন
প্রতিদিন সন্ধার পরপর ৪/৫ যুবক গ্রামের বা শহরের কোলাহল মুক্ত স্থানে বসে নিজের মোবাইলে একের পর এক তাসের গতি চালিয়ে খেলছে জুয়া। অনেকে আবার নিজস্ব অ্যাবসের মাধ্যমে খেলা নিয়ে ধরছে বাজি। যদি তার দল জিতে তবে তিনি পাবেন তার তিনগুন টাকা। তবে হারলে কিছুই হবে না। মোবাইলে নিজের নিবন্ধনকৃত অ্যাবসে নির্দিষ্ট পরিমার টাকা হলে তা বিকাশ বা নগদে উত্তোলন করা যাবে। শুরুতে কিছু টাকা দিয়ে আসক্ত করা হয় তাদের। টাকার অংক বাড়লে অ্যাবস আর কাজ করে না। এভাবেই নি:স্ব হচেছ স্কুল কলেজ পড়ুয়া যুবক-যুবতীরা। তাসখেলা অনেকের কাছে একটি খেলা হলেও আমাদের দেশে এটি এখনো জুয়ার একটি সহজ ও বহুল প্রচলিত মাধ্যম।
বাংলাদেশে সরকারিভাবে জুয়া নিষিদ্ধ হলেও গ্রাম ও শহরে যুগে যুগে নানা উপায়ে জুয়ার প্রচলন ছিল এবং বর্তমানে এর ধরন অনেক বদলে গেছে। বর্তমানের মতো এর ব্যাপক চর্চা অতীতে ছিল না এবং খুব কম মানুষই এ ধরনের খেলায় প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিত। যদিও আরও অনেক রকম জুয়া আছে, যা প্রচলিত ধারণায় হয়তো জুয়া নয়; কিন্তু সেখানেও অর্থের লেনদেন হয়। যেমন, অনেক সময় দেখা যায় ব্যক্তিগতভাবে দুজন বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে কোনো কথা বা কাজ করা নিয়ে ‘বাজি’ ধরা হয় এবং বাজি হিসাবে অর্থ বা মূল্যবান কোনো পণ্য বা অন্যকিছু বিজয়ীদের দেওয়া হয়। বর্তমানে অনেক যুবক আকৃষ্ট হচ্ছে বিভিন্ন জুয়ার সাইটে। পাঁচ-দশ হাজার টাকার বিনিয়োগে শুরু করে লোভে পড়ে একপর্যায়ে খোয়াচ্ছে লাখ লাখ টাকা। জুয়ার এসব সাইটের অধিকাংশ পরিচালনা করা হচ্ছে ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে। বিদেশ থেকে পরিচালিত এসব সাইট পরিচালনা করছে বাংলাদেশের এজেন্টরা। জুয়ায় বিনিয়োগ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে বিদেশে লেনদেনের সহজ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলাদেশি মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস)। সবচেয়ে অবাক করা বিষয়- বিদেশ থেকে পরিচালিত জুয়ার সাইটে বাংলাদেশিদের লেনদেনের জন্য মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায় যুক্ত। এছাড়া রয়েছে ব্যাংকের মাধ্যমেও পেমেন্ট করার সুযোগ। ব্যাংক এশিয়া, ব্র্যাক ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন করা যায় এসব সাইটে।
মোবাইলে ফেসবুক চালু করলেই স্কিনে ভেসে উঠছে একাধিক অনলাইন জুয়ার পেজ। ফেসবুক আইডি, পেজ, গ্রুপ, ওয়েবসাইট ও মোবাইলভিত্তিক এনক্রিপ্টেড অ্যাপ দিয়ে চলছে এই জুয়ার সাইটগুলো। এতদিন বিদেশি আয়োজনে এসব জুয়ার সাইট চললেও এখন দেশিয় অনেক প্রতিষ্ঠান এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষও বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা এসব জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। খোয়াচ্ছে বিপুল পরিমাণ টাকা। অনেকে ধার-দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়ছেন। কিছুদিন আগে জুয়ায় সর্বস্ব হারানো এক জন ব্যাংক কর্মকর্তার ব্যাংক থেকে টাকা চুরির ঘটনা বেশ আলোচনার সৃষ্টি করেছিল। খেটে খওয়া মানুষ দিনের উপার্জনের পুরোটাই দিয়ে দিচ্ছেন এসব অনলাইন জুয়ায়। সম্প্রতি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন- বিটিআরসি ৩৩১টি জুয়ার সাইট বন্ধ করছে। বিটিআরসি বলছে, ক্রেডিট বা ডেভিড কার্ড সহজলভ্য হওয়ায় অনেকেই ঝুঁকে পড়েছে অনলাইন জুয়ায়। এই সুযোগে অপরাধী চক্র বিদেশে পাচার করছে কোটি কোটি টাকা। সম্প্রতি সিআইডির অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, ‘বিগো লাইভ’ গত ২০ মাসে সিঙ্গাপুরে পাচার করেছে ১০৯ কোটি টাকা। সবার চোখের সামনে এটা অবাধে চললেও খুব বেশি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। তিন পাত্তি গোল্ড’ তিন পাত্তি গোল্ড মূলত একটি অ্যাপ যা মোবাইলে ডাউনলোড করে খেলা যায়। জানা যায়, এই অ্যাপের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ মুনফ্রগ ল্যাবের হাতে। এটি ছাড়াও ‘রাখি’, ‘আন্দর বাহার’ ও ‘পোকার’ নামেও অনলাইন জুয়ার গেমস রয়েছে। তিন পাত্তি গোল্ডে রেজিস্ট্রেশনের পর একজন গ্রাহককে খেলার জন্য কিছু ‘চিপস’ ফ্রি দেওয়া হয়। সেগুলো শেষ হয়ে গেলে গেম খেলতে টাকা দিয়ে চিপস কিনতে হয়। মূলত মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে চিপস কেনার লেনদেন হত। এভাবে প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার কোটি চিপস বিক্রি হয় এবং প্রতি কোটি চিপস বিভিন্ন পর্যায়ে ৪৬ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হয় বলে জানা যায়। সেখানে বলা হয়, বিভিন্ন ‘বট প্লেয়ার’ বা কম্পিউটারের স্বয়ংক্রিয় প্লেয়ারের মাধ্যমে মূল গেমারদের কৌশলে হারিয়ে প্লেয়ারদের আরও চিপস কিনতে উৎসাহিত করা হয়। বাংলাদেশে এই তিন পাত্তি গোল্ডের চিপস বিক্রির কাজটি ১৪টি অফিসিয়াল ডিস্ট্রিবিউটর ও এজেন্টের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এসব ডিস্ট্রিবিউটরদের আবার সাব ডিস্ট্রিবিউটরও রয়েছে। বর্তমানে ‘তিন পাত্তি গোল্ডের’ প্রায় ৯ লাখ নিয়মিত গেমার রয়েছেন এবং প্রতিদিন প্রায় ৩০ লাখ টাকার চিপস বিক্রি হয় বলে জানায় র্যাব।
বিশ্বকাপ ঘিরে নতুন শঙ্কা টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ ঘিরেও নতুন করে সক্রিয় হতে দেখা যাচ্ছে দেশি ও বিদেশি জুয়ার বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত ২০১৬ সাল থেকে ক্রিকেটকে ঘিরে বাংলাদেশে অনলাইনে জুয়ার আগ্রহ বাড়তে থাকে। তখন কিছু যুবক খেলার ওয়েবসাইট খুলে মানুষকে যুক্ত করে বেটিংয়ে অংশ নিতে আহ্বান জানায়। পরবর্তীকালে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সাইট থেকে ব্যবহারকারীদের অ্যাপে শিফট করা হয়। বিটিআরসির এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ফেসবুক ও ইউটিউবের মাধ্যমে জুয়া খেলার ওয়েবসাইট ও গুগল অ্যাপের প্রচার এবং অনলাইন জুয়া সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেওয়ায় এ ধরনের ২৭টি ফেসবুক লিংক এবং ৬৯টি ইউটিউব লিংক বন্ধের জন্যও রিপোর্ট করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ১৭টি ফেসবুক ও ১৭টি ইউটিউব লিংক বন্ধ করা হয়েছে এবং অবশিষ্ট লিংকগুলোর বন্ধ করার কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। জুয়া খেলার মাধ্যমে অর্থপাচারের সুযোগ তৈরি হওয়ার কথা জানিয়ে বিটিআরসি বলছে, অ্যাপের নিয়ম অনুযায়ী খেলার চিপস কিনতে প্রয়োজন পড়ে নগদ অর্থ, ক্রেডিট বা ডেভিড কার্ড। এগুলোর মাধ্যমেই অপরাধী চক্র দেশ থেকে টাকা পাচার করে থাকে। মোবাইল অ্যাপ ছাড়াও অপরাধীরা বিভিন্ন ওয়েবসাইট বা ডোমেইনের মাধ্যমে সরাসরি অনলাইন গেইম বা জুয়া খেলায় অংশগ্রহণ করে থাকে। এজন্য দেশে এবং বিদেশে হোস্টকৃত বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রথমে অ্যাকাউন্ট খুলে নিবন্ধন করা হয়। তারপর নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্য কার্ড বা অন্য কোনো মাধ্যমে জমা দিয়ে জুয়ায় অংশ নিতে হয়।
অনলাইন জুয়াড়িরা বিকাশ, রকেট, নগদসহ বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা নেয়। প্রকাশ্যে এর হার কমলেও অনলাইনে এ খেলার প্রবণতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে এবং এতে আসক্ত হচ্ছে তরুণ-তরুণীরা। নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে হাজারো মানুষ এবং তাদের পরিবার। ‘বিগো লাইভ’ ‘বিগো লাইভ’ নামে সিঙ্গাপুরভিত্তিক অ্যাপের মাধ্যমে আপত্তিকর কনটেনট ছড়িয়ে ২ কোটি বাংলাদেশি ব্যবহারকারীর কাছে থেকে ২০ মাসে ১০৯ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। সিআইডির অনুসন্ধান বলছে, হাতিয়ে নেওয়া এই টাকার বেশির ভাগ বিদেশে পাচার করেছে প্রতিষ্ঠানটি। সিআইডি জানিয়েছে, বিগো লাইভ অ্যাপের মাধ্যমে অসামাজিক কার্যক্রমে জড়িত চীনা ব্যবসায়ীর সঙ্গে আরো কেউ জড়িত রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সিআইডি বলছে, ২০ মাসে প্রতিষ্ঠানটি হাতিয়ে নিয়েছে ১০৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৯ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময় ব্যাংক থেকে তোলা হয়েছে আরো ১৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশের দুইটি ব্যাংকে থাকা অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। এই দুটি অ্যাকাউন্টে বর্তমানে ২৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা জমা রয়েছে। এসব টাকার বিষয়ে আদালত নির্দেশনা দেবে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
- » সাপ্তাহিক ফেনী সংবাদ এর প্রতিনিধি সমাবেশ অনুষ্ঠিত
- » ফেনীতে আড়াই হাজার রোগীকে বিনামূল্যে চোখের চিকিৎসা সেবা দিল লায়ন্স ক্লাব
- » ফেনীতে তারুণ্য নির্ভর বাংলাদেশ বিনির্মাণ বিষয়ক আলোচনা সভা
- » ফেনীর মাহবুবুল হক পেয়ারা সুইমিংপুল ২৫ বছরেও চালু হয়নি! # এখন এটি বখাটে ও মাদকসেবীর আড্ডাখানা, পরিচর্যার অভাবে নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান যন্ত্রপাতি, দেয়ালে ধরেছে ফাটল
- » প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়, তারা সমাজের একটা সম্পদ- ফেনী জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম
- » ঘোষণা হতে পারে ফেনী জেলা যুবদলের নির্বাচনমুখী নতুন কমিটি
- » ফেনীর লেমুয়া ইউনিয়নের নেয়ামতপুরে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প ও ঔষধ বিতরণ
- » নিঃস্ব দুই হাজার ৫শত পোল্ট্রি খামারি, ক্ষতি ৩৯৬ কোটি টাকা
- » ফ্রি-ল্যান্সিং প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছে বেকাররা- নাসিম এমপি
- » ফেনীতে গ্যাস সংকটে চরম ভোগান্তি